বগুড়া জেলার গাবতলী উপজেলার ইছামতি নদী তীরবর্তী পোড়াদহ নামক স্থানে প্রতিবছর এক ঐতিহ্যবাহী লোকজ মেলার আয়োজন করা হয়। প্রায় ৪০০ বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে আয়োজিত প্রাচীন এই মেলাটি পোড়াদহ মেলা (Poradaha Mela) নামে পরিচিত। বগুড়া শহর থেকে পোড়াদহ মেলা প্রাঙ্গণের দূরত্ব মাত্র ১১ কিলোমিটার। পোড়াদহ মেলা কত সালে শুরু হয় সেই সম্পর্কে সঠিক তথ্য জানা না গেলেও ১৬শ শতাব্দীকে এই মেলার উত্থান হিসাবে মানা হয়। জানা যায়, প্রায় চারশত বছর আগে হঠাৎ মেলার স্থানে থাকা বটবৃক্ষের নিচে এক সন্ন্যাসীর আগমণ ঘটে। ধীরে ধীরে সেখানে অন্যান্য সন্ন্যাসীরাও আসতে শুরু করে এবং এখানে একটি আশ্রম প্রতিষ্ঠা করা হয়। ফলে জায়গাটি এলাকার হিন্দু সম্প্রদায়েরর কাছে তীর্থস্থানে পরিণত হয়। তখন থেকেই হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন মাঘ মাসের শেষ তিন দিনের মধ্যে আগত বুধবার সন্ন্যাসী পূজার আয়োজন শুরু করে। সন্ন্যাসী পূজায় দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ভক্তদের সমাগত হতে শুরু করে। পর্যায়ক্রমে পূজা অনুষ্ঠানের দিনটি গ্রাম্য মেলার রূপ লাভ করে। পরবর্তীতে সন্ন্যাসীরা এ স্থান ত্যাগ করে চলে গেলেও স্থানীয় হিন্দুরা সন্ন্যাসী পূজার আয়োজন করে চলছে।
মেলার নামকরণ
শুরুতে পোড়াদহ মেলাকে সন্ন্যাসী মেলা নামে ডাকা হতো। কিন্তু পোড়াদহ নামক স্থানে মেলা আয়োজনের কারণে লোকমুখে পোড়াদহ জায়গার নাম প্রচার হতে থাকে। একসময় পোড়াদহ মেলা নামটিই স্থায়ী হয়ে যায়। পোড়াদহ মেলা নামের পাশাপাশি স্থানীয় মানুষজন এই মেলাকে ‘জামাই মেলা’ ও ‘মাছের মেলা’ হিসাবে আখ্যায়িত করে থাকেন।
মেলা আয়োজনের সময়
প্রতিবছর বাংলা সনের মাঘ মাসের শেষ তিন দিনের মধ্যে আগত বুধবার অথবা ফাল্গুন মাসের প্রথম বুধবার এই মেলার আয়োজন করা হয়। তবে বুধবার মেলার প্রধান দিন হলেও বুধবারের আগের ৩দিন এবং পরের ২দিন পর্যন্ত পোড়াদহ মেলা স্থায়ী হয়। বুধবারের পরদিন অর্থাৎ বৃহস্পতিবার দিনটি বৌমেলা হিসাবে খ্যাত। এই দিন গ্রামের বধূরা ও স্বামীর বাড়ি থেকে বাবার বাড়িতে আসা কন্যারা তাদের স্বামীর সাথে মেলায় কেনাকাটা করতে আসে। বৌমেলা হলেও ঐদিন অবিবাহিতদের মেলায় আগমনে কোন নিষেধ নেই।
মেলায় যা আছে
মাছ: বাহারি সব মাছ পোড়াদহ মেলার অন্যতম প্রধান আকর্ষণ। মেলা উপলক্ষ্যে তৈরি অস্থায়ী আড়তে এসে জমা হয় বিশালাকারের সব মাছ। কোন কোন সময় একেকটা মাছের ওজন দুই মণকেও ছাড়িয়ে যায়।
মিষ্টি: মাছের সাথে সাথে পোড়াদহ মেলার প্রাণজুড়ে থাকে বিভিন্ন ধরনের মিষ্টির স্বাদ। সন্দেশ, রসগোল্লা, জিলাপী ছাড়াও দেড় থেকে দুই কেজি ওজনের মিষ্টি মেলা থেকে বাদ যায় না।
আসবাবপত্র: পোড়াদহ মেলায় কাঠ, স্টিল ও লোহার তৈরী বিভিন্ন ডিজাইনের আসববাপত্র বেশ সূলভ মূল্যে পাওয়া যায়।
কসমেটিকস ও উপহার সামগ্রী: নানাবিধ কসমেটিক, খেলনা, উপহার সামগ্রীর দোকানে মেলা প্রাঙ্গণ থাকে পরিপূর্ণ। এসব দোকান থেকে খেলনা ও প্রসাধনী কিনতে শিশু ও মহিলাদের ভিড় লেগেই থাকে।
খাবারের দোকান: মেলা প্রাঙ্গণ জুড়ে অসংখ্য অস্থায়ী হোটেল, ফুচকা-চটপটির দোকান, পুড়ি-সিঙ্গারার দোকান, আচার ও আইসক্রিমের দোকান গড়ে উঠে।
বিনোদন আয়োজন: মেলায় বিনোদনের জন্য বরাদ্দকৃত স্থানটি সবসময় থাকে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে। ছোট বড় সকলের বিনোদনের জন্য মেলায় স্থান পায় নাগরদোলা, মিনি ট্রেন, ঘোড়ার গাড়ি, ম্যাজিক, সার্কাস, মটর সাইকেল খেলা, যাত্রাপালা ও বিভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
এছাড়া পোড়াদহ মেলায় নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস যেমন বিভিন্ন প্রকার সবজি (কাঁচাবাজার), মাংস, মসলা সহ গৃহস্থালীতে দৈনন্দিন ব্যবহার্য জিনিসপত্র কিনতে পাওয়া যায়।
কিভাবে যাবেন
বগুড়া জেলা সদরের চেলোপাড়ায় গোলাবাড়ি সিএনজি স্ট্যান্ড থেকে সিএনজি বা অটোরিক্সায় চড়ে পোড়াদহ মেলায় যাওয়া যায়।
বাসে ঢাকা থেকে বগুড়া: রাজধানী ঢাকার গাবতলী, মহাখালী, শ্যামলী, আবদুল্লাহপুর, কল্যাণপুর থেকে বগুড়া যাওয়ার বাস পাওয়া যায়। বগুড়াগামী বাস সার্ভিসের মধ্যে শ্যামলী পরিবহন, এসআর ট্রাভেলস, হানিফ এন্টারপ্রাইজ, একতা পরিবহন, বাবুল এন্টারপ্রাইজ, এসএ পরিবহন, শাহ ফতেহ আলী পরিবহন উল্লেখযোগ্য। বগুরাগামী এসি ও নন-এসি বাসের ভাড়া ৪৫০-১১০০ টাকা।
ট্রেনে ঢাকা থেকে বগুড়া: ঢাকা থেকে লালমনি এবং রংপুর এক্সপ্রেস ট্রেন বগুড়া হয়ে যাতায়াত করে তাই এই ট্রেনগুলোতে চড়ে বগুড়া যেতে পারবেন। ঢাকা থেকে রংপুর এক্সপ্রেস ট্রেন প্রতিদিন সকাল ৯ টা ১০ মিনিটে যাত্রা করে এবং লালমনি এক্সপ্রেস যাত্রা করে রাত ৯ টা ৪৫ মিনিটে। রংপুর এবং লালমনি এক্সপ্রেস ট্রেন যথাক্রমে সোমবার এবং শুক্রবার বন্ধ থাকে। আসনভেদে ট্রেনের টিকেট এর মূল্য ৩৯৫-৯০৯ টাকা।
কোথায় থাকবেন
বগুড়ায় অবস্থিত ভালমানের আবাসিক হোটেলের মধ্যে পর্যটন মোটেল, নাজ গার্ডেন, নর্থওয়ে মোটেল, সেফওয়ে মোটেল, মোটেল ক্যাসল এমএইচ, সেঞ্চুরি মোটেল, হোটেল সিস্তা, হোটেল আকবরিয়া, রেডচিলিস চাইনিজ রেষ্টুরেন্ট এন্ড আবাসিক হোটেল উল্লেখযোগ্য। আর সাধারণ মানের হোটেলের মধ্যে হোটেল আল আমিন, হোটেল রয়াল প্যালেস, হোটেল সান ভিউ, হোটেল রাজমনি, হোটেল হানি ডে, হোটেল আজিজ প্রভৃতি অন্যতম।
ফিচার ইমেজ: মোঃ আতিকুর রহমান রঞ্জু
ভ্রমণ সংক্রান্ত যে কোন তথ্য ও আপডেট জানতে ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেইজ এবং জয়েন করুন আমাদের ফেসবুক গ্রুপে।