ঝিনাইদহ জেলা শহর থেকে প্রায় ২৬ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত বারোবাজার (Barobazar) বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নস্থল। ইতিহাস থেকে জানা যায়, প্রায় ৭০০ বছরের প্রাচীন ১০ বর্গমাইল পরিধির বারোবাজার নগরী বারোটি পৃথক বাজারের জন্য তৎকালীন সময়ে বেশ প্রসিদ্ধ ছিল। বারোবাজার নগরীর গ্রামগুলো হল- পিরোজপুর, খোশালপুর, সাদেকপুর, বাঁদুরগাছা, সাতগাছিয়া, দৌলতপুর, মুরাদগড়, এনায়েতপুর, মোল্লাডাঙ্গা, রহমতপুর এবং বাদেডিহি।
১৯৯৩ সালে বারোবাজার রেললাইন সংলগ্ন ৩ বর্গকিলোমিটার জায়গা খনন করে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ মসজিদ, সমাধিক্ষেত্র, করবস্থান, বন্দর এবং লৌকিক ভবন মিলিয়ে প্রায় ১৫ টি ভিন্ন ভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের সন্ধান পায়। প্রাপ্ত নিদর্শনগুলোর মধ্যে আছে সাতগাছিয়া মসজিদ, নামাজগাহ কবরস্থান, ঘোপের ঢিপি কবরস্থান, জোড়বাংলা মসজিদ, গলাকাটা মসজিদ, জাহাজঘাটা, মনোহর মসজিদ, গোড়ার মসজিদ, দমদম প্রত্নস্থান, শুকুর মল্লিক মসজিদ, পীর পুকুর মসজিদ, পাঠাগার মসজিদ, বাদেডিহি কবরস্থান, খড়ের দীঘি কবরস্থান ও নুনগোলা মসজিদ। আর সাংস্কৃতিক বস্তুর মধ্যে আছে উৎকীর্ণ লিপি, অলংকৃত ইট, মৃৎপাত্র, পোড়ামাটির ফলক, গুটিকা, মৃৎপাত্রের ভাঙা টুকরো ইত্যাদি।
এসব নিদর্শনের পাশে বিরাট আকারের দীঘির অবস্থান বিশেষ ভাবে চোখে পড়ার মত। আর এখানকার মসজিদগুলোর সাথে বাগেরহাট জেলার বেশকিছু মসজিদের অনেক মিল দেখা যায়। উদ্ধারকৃত নিদর্শনের এলাকাকে বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ ‘শহর মোহাম্মদাবাদ’ নামকরণ করে। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের মতে প্রাপ্ত নিদর্শনগুলো পঞ্চদশ শতাব্দীর। তবে জোড়বাংলা মসজিদের থেকে পাওয়া শিলালিপিতে হিজরি ৮০০ সনের উল্লেখ দেখে নিদর্শনগুলো ৭০০ বছরের প্রাচীন বলে মনে করা হয়।
যা যা দেখবেন
জোড়বাংলা মসজিদ
জোড়বাংলা মসজিদ নিয়ে প্রচলিত আছে, মসজিদের কাছে একজোড়া কুঁড়েঘর থাকার কারণে মসজিদটির এমন নামকরণ করা হয়েছে। সুলতান গিয়াস উদ্দিন মাহমুদ শাহের শাসন আমলে নির্মিত এক গম্বুজবিশিষ্ট এই মসজিদের পূর্ব দিকে তিনটি সুচালো খিলানযুক্ত প্রবেশপথ রয়েছে। আর মসজিদের চার কোণায় আছে কারুকাজ খচিত ৪ টি টাওয়ার।
গোড়ার মসজিদ
বেলাট দৌলতপুরে অবস্থিত কারুকাজ খচিত বর্গাকৃতির গোড়ার মসজিদের ছাদে চারটি গম্বুজ রয়েছে। শিকল নকশা, পোড়ামাটির নকশা, বৃক্ষপত্রাদীর নকশা এবং পুষ্পশোভিত পোড়ামাটির নকশায় গোড়ার মসজিদের মেহরাব ও দেয়াল সুজজ্জিত আছে। আর মসজিদের পূর্ব দিকে একটি বিশাল দীঘি রয়েছে।
শুকুর মল্লিক মসজিদ
বর্গাকাকৃতির এক গম্বুজবিশিষ্ট শুকুর মল্লিক মসজিদ দেখতে অনেকটা ঢাকার বিনত বিবির মসজিদের মতো। মসজিদের মূল মেহরাবের উভয় পাশে একটি করে বন্ধ মেহরাব রয়েছে। মেহরাবগুলোতে পোড়ামাটির অপরূপ নকশা অঙ্কিত রয়েছে।
গলাকাটা মসজিদ
গলাকাটা মসজিদ বারোবাজারে অবস্থিত সুলতানি আমলের অনিন্দ্য এক স্থাপত্য নিদর্শন। গোলাকার কাঠামোর উপর নির্মিত মসজিদে ৩ টি সুসজ্জিত মেহরাব আছে। মেহরাবগুলোতে আছে পোড়ামাটির বিভিন্ন রকম ফুল ও জ্যামিতিক নকশা। এছাড়া পোড়ামাটির অপূর্ব নকশা থেকে বাদ যায়নি মসজিদের দেয়াল ও ছাদ। মসজিদের পাশে একটি বৃহদাকার দীঘি রয়েছে।
নুনগোলা মসজিদ
বর্গাকৃতির নুনগোলা মসজিদে বিভিন্ন জ্যামিতিক নকশা অঙ্কিত ৩টি অর্ধবৃত্তাকৃতির মেহরাব রয়েছে। এক গম্বুজ বিশিষ্ট নুনগোলা মসজিদের বাইরের দেয়ালটি পর্যায়ক্রমিক খাড়া চাল ও খাঁজযুক্ত। চাল ও খাঁজগুলোতে দিগন্ত রেখাকৃতির ছাঁচে গড়া নকশা ও বাঁধন রয়েছে।
যেভাবে যাবেন
রাজধানী ঢাকার গাবতলী হতে সরাসরি কালীগঞ্জগামী বাস পাওয়া যায়। রয়েল এক্সপ্রেস, পূর্বাশা পরিবহণ, শ্যামলী, হানিফ এন্টারপ্রাইজ, জে আর, সৌদিয়া, সোনার তরী, চুয়াডাঙ্গা ডিলাক্স, মামুন এন্টারপ্রাইজ এবং এসবি পরিবহনের এসি/নন-এসি বাস এই রুটে চলাচল করে। এসি/নন-এসি বাসের জনপ্রতি টিকেটের মূল্য ৪৫০ থেকে ১০০০ টাকা। কালীগঞ্জ থেকে বারোবাজারের দূরত্ব মাত্র ১১ কিলোমিটার। কালীগঞ্জ হতে ইজিবাইক বা সিএনজি ভাড়া করে বারোবাজার যাওয়া যায়।
যশোর জেলা শহর থেকে বারোবাজার ১৬ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। তাই ঢাকা থেকে বাস, ট্রেন কিংবা বিমানে চড়ে যশোর এসে সহজেই বারোবাজার যেতে পারবেন।
কোথায় থাকবেন
থাকার জন্য ঝিনাইদহে বিভিন্ন মানের আবাসিক হোটেল রয়েছে। এদের মধ্যে হোটেল ড্রীম ইন্টারন্যাশনালের এসি/নন-এসি রুমে এক রাত থাকতে ৭০০ থেকে ১৫০০ টাকা খরচ করতে হবে। আর হোটেল কুটুমে থাকতে হলে গুনতে হবে ৫০০ থেকে ৮০০ টাকা।
আর যশোর থাকতে চাইলে যোগাযোগ করতে পারেন হোটেল সিটি প্লাজা ইন্টারন্যাশনাল (01795-477977), হোটেল হাসান ইন্টারন্যাশনাল (0421-67478), হোটেল শামস ইন্টারন্যাশনাল (0421-71564), জাবীর ইন্টারন্যাশনাল হোটেল (01880-004044), হোটেল আরএস ইন্টারন্যাশনাল (0421-62617)।
কোথায় খাবেন
ঝিনাইদহ (Jhenaidah) শহরে আহার, ফুড সাফারী, সুইট, ঘরোয়া ইত্যাদি রেস্টুরেন্টে প্রয়োজনীয় খাবারের পাশাপাশি ঘোষ এর মিষ্টি, পায়রা চত্ত্বরের ছানা ও ছানার জিলাপী খেয়ে দেখতে পারেন।
যদি যশোর রাত্রিযাপন করেন তবে এখানকার বিখ্যাত জামতলার মিষ্টি, খেজুরের গুড়ের প্যারা সন্দেশ ও ভিজা পিঠা খেয়ে দেখতে পারেন। এছাড়া চার খাম্বার মোড়ের ‘জনি কাবাব’ থেকে কাবাব, ফ্রাই, চাপ বা লুচি, ধর্মতলার মালাই চা এবং চুক নগরের বিখ্যাত চুই ঝাল খাবারের স্বাদ থেকে নিজেকে বঞ্চিত করা মোটেও ঠিক হবে না।
ফিচার ইমেজ : Amanullah Al Nahid
ভ্রমণ সংক্রান্ত যে কোন তথ্য ও আপডেট জানতে ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেইজ এবং জয়েন করুন আমাদের ফেসবুক গ্রুপে।